বদ্ধ না মুক্ত
নরেনদা চিরকাল নিয়ম করে জীবন কাটিয়েছেন। কেবল অফিসের পার্টি ছাড়া তরল বা ধোঁয়া গলার নীচে কোনদিন নামান নি। তবু রিটায়ারমেন্টের এক বছর আগে থেকেই কিডনি গোলমাল ধরা পড়ে। যে কোম্পানিতে কাজ করতেন, তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধে হল মেডিকেল সাহায্য। এমনকি রিটায়ারমেন্টের পরেও। সেই সুবাদে এখন দুদিন বাদ দিয়ে দিয়ে ডায়ালিসিস করাতে যেতে হয়। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবেন। সঙ্গে বৌদিকে রোজ যেতে হয়, ঘরও সামলাতে হয়, হাসপাতালে যাবার দিন সকালে রান্না করে সাথে করে নিয়ে যান, ডায়ালিসিস গ্যাপের মধ্যে দুজনে একসাথে সেই খাবার ভাগ করে খান- লাঞ্চ! দাদা রোগে বদ্ধ, বৌদি দায়িত্বে আর প্রীতিতে বদ্ধ। অথচ এখন ওদের কিছুটা মুক্ত চিন্তা করার সময় এসেছিল।
কিন্তু এই বিশেষ উদাহরণটি ছাড়াও আমরা সকলেই বদ্ধ প্রাণী। জন্ম ইস্তক আমরা সকলেই বদ্ধ। শিশু বয়সে মায়ের কাছে বদ্ধ, একটু বড় হয়ে জীবন স্কুল বদ্ধ, নিজেকে ভালো স্টুডেন্ট হিসাবে বানানোতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ, একে একে প্রেমে বদ্ধ, চাকরিতে বদ্ধ, সংসার নামক জোয়ালে দায়িত্ব বদ্ধ, বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য দায়বদ্ধ, সম্পর্কের জালে বদ্ধ, নিয়ম নীতিতে বদ্ধ, আমরা সব সময় বদ্ধ। নানা সীমারেখা দিয়ে আমাদের সমাজ, আমাদের সভ্যতা আমাদের বেঁধেই রেখেছে। এই বদ্ধতার বাইরে যারা আছে তারা সাধারণ মানুষ নয়-তারা হয় জিনিয়াস, বা মহাত্মা, বা চোর ডাকাত, বা অসুস্থ (মানসিক) কিংবা পলিটিশিয়ান। এই অবদ্ধদের নিয়ে সাধারণ সুস্থ সমাজ জীবনে কোন অসুবিধে নেই কেবল শেষের জনকে ছাড়া। তাকে একবার ক্ষমতা হাতে পাবার পর,আমরা কিছুতেই বাধ্যতা নিয়ম নীতি সুকার্য্য কোন কিছু দিয়েই সঠিক পথে বদ্ধ করতে পারি না। আমার আজকের আলোচনায় এদের আমি দূরেই রাখতে চাই। স্বাধীনতা উত্তোর ভারতবর্ষে এরা কবে কতগুলি কাজ দায়বদ্ধতার সাথে করেছেন, তা এক আঙুলে গোণার মতোই। এই বদ্ধতার উলটো হল মুক্তি। রবীন্দ্রনাথের গানে সোনার খাঁচার পাখী যে মুক্তির আকুতি জানিয়েছিল, সেই মুক্তি। মুক্তি মানে কি ? সব রকম বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, ঘাসে ঘাসে, এই আকাশে’। এই মুক্তি আমরা কজনে চাই? কার কাছ থেকে চাইতে হবে তাও আমরা সাধারণে জানিনা। এমনকি জানার প্রয়োজনও অনুভব করি না। বদ্ধতা কি কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম? না’তো। সে তো আজন্ম আমার সাথে সাথেই জুড়ে চলেছে আমার অস্তিত্বের সাথে। কোনটাকে অবহেলা করেছি, কোনটাকে সামলেছি, নিজের ইচ্ছেয়, প্রয়োজনে অথবা স্বার্থের খাতিরে। সেখানেই আমার সত্তার সরব উপস্থিতি, প্রচ্ছন্ন গর্ববোধ। আমার কাছে মুক্তির মানে হয়ে গেছে যে কোন সমস্যা থেকে লাভজনক উপায়ে পেছন ছাড়ানো। তাহলেই সফলতার মুক্তি। কিন্তু একবারও মাথায় আসছে না এই সমস্যাগুলি উৎপন্ন হচ্ছে কেন ? আমি বা আমরাই কি করছি না তাদের উৎপন্ন ? কারন বদ্ধতা আর মুক্তির মাঝখানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর একটা দরজা আছে- যাকে পার করা সবচেয়ে দুরুহ। তার নাম আকাঙ্খা। আকাঙ্খা ঠিক পুরো লোভ নয়, আবার ঠিক উচ্চাশাও নয়, কিছুটা ইচ্ছে, কিছুটা স্বপ্ন আর সামান্য লোভ মিলিয়ে একটা বস্তু যার নেশা আফিং এর মতো- মাঝে মাঝেই তার যোগান দিতে হয়। বদ্ধতা আর আকাঙ্খা- দুই এর যাঁতাকলে পড়ে আমরা পিষতেই থাকি, কিছুতেই দরজার ওপারে কি আছে দেখার চেষ্টা করি না।
আমি বোধহয় সব্বাইকে গুলিয়ে দিলাম। একটু পরিষ্কার করা যাক। সাংসারিক জীব হিসেবে আমাদের এই বদ্ধতা ও আকাঙ্খা থেকে মুক্ত হবার আশু কোন উপায় নেই। এর উপায় নিজের অন্তরাত্মার কাছে লুকিয়ে আছে। কতটা বাঁধবো আর কতটুকু চাইবো এ সবই নিজের আয়ত্তের মধ্যে। তার জন্যে নিজের ভিতরের নিজেকে মাঝে মাঝেই দেখার চেষ্টা করতে হবে। সোজা কথায় নিজেকে চিনতে হবে। আর পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে নিজের অবস্থানকে গুগল করে নিতে হবে। তবেই হয়তো আফিং এর প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমতে পারে। জীবনকে প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে গড়ে তুলতে হবে। এই প্রয়োজন যতটুকু শুধু সেটাকে বাক্সবন্দী করতে হবে। একবার যদি তাতে সফলতা আসে, তাহলে অনেকটা সময় ভিতরের নিজের জন্য পাওয়া যাবে। একটা কথা আমি খুব জোরের সাথে বলতে চাই- কেউ যদি মনে করেন কেবল বায়োলজিকাল মিলনের রেজাল্ট হেতু আপনি এই পৃথিবীতে এসেছেন, তাহলে সেটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিন। আমরা কোথা থেকে এসেছি, কি ভাবে এসেছি সেই সব যদি বিস্তারিত খুলে দেখি, তাহলে সেই সকল বায়োলজিক্যাল কারণ বা ঘটনা আমাদের শুণতে বা দেখতে ভালো লাগবে না। ইভোলিউশান কিন্তু কোন সহজ পথ ধরে আসে নি। এতো লক্ষ লক্ষ প্রাণি থাকতে আমাদের মধ্যেই কেন এই জ্ঞানচক্ষুর বিকাশ ঘটলো ? ইন্টেলিজেন্স কেন আমাদের শুধু দৈনন্দিন যাপনের বাইরেও কেন ভাবাতে শেখালো ? সেই ভবিষ্যত যা আমাদের জ্ঞাত নয়, কেন তার জন্যে আমরা কুশলতা, জ্ঞান আর কল্পনার দ্বারা বদ্ধ হলাম? আমাদের প্রত্যেকের জীবনের একটা মূল উদ্দেশ্য আছে- সেটাকে জানতে হবে। সেই জানার রাস্তাটা ঐ আকাঙ্খার দরজার এপারে আছে- সেখানে পৌঁছাতে হবে নিজের ইচ্ছের জোরে, মানসিকতার জোরে, জ্ঞানের ভরষায়। এই সব করতে গেলে যে সময় চাই তাকে ঐ প্রয়োজনের সীমিত আয়তনের বাইরে থেকে চুরি করে একত্রিত করে নিয়ে আসতে হবে। তখন মুক্তির দরজা একটু একটু করে দেখা যাবে। এই মুক্তি ফ্রীডম বা স্বাধীনতা নয়। এই মুক্তি হল মোক্ষ। আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য মোক্ষলাভ করার চেষ্টা করা। মাঝখানের সমস্ত কিছুই এক একটা ডাইভার্শান- রাস্তা গুলিয়ে দেবার জন্য। শক্ত হাতে চালকের আসনে বসুন- সব ঘুরপথ পেরিয়েও নিজেকে নিয়ে চলুন সেই পথে যেখানে বদ্ধের সাথে মুক্তির চির বৈরীতা। এক পরম আস্বাদনের দরজা উন্মুক্ত হোক জীবনের এই কালচক্রে। চরৈবেতি।
No comments:
Post a Comment