লকডাউন

 সকালে বণ্ড-কে নিয়ে বেরোতে হয় রোজই। বন্ড সোনাথের পোষ্যটির নাম। ফেরার পথে সোসাইটির গেট থেকে বিগ বাস্কেটের দুধের সবুজ বাক্সটা তুলে নেয় সোমনাথ। আজ সোমবার। লিফটে তিনতলা, ঘরে ঢুকে বণ্ডকে চেনমুক্ত করে, দুধের বাক্সটা খোলে সোমনাথ। গিন্নী এখনও ওঠে নি। দুধ-দই এর প্যাকেটগুলো বের করে ফ্রিজে রাখে। এই সময় চোখে পড়ে, একটা ভাঁজ করা কাগজ, ব্যাগের ভেতর। কাগজটা ঠান্ডা প্যাকেটের সাথে থেকে কিছুটা নেতিয়ে রয়েছে। সাবধানে ভাঁজখুলে মেলে ধরতেই, সোমনাথের হাত থেকে কাগজটা মেঝেতে পড়ে যায়। নীচু হয়ে মাটি থেকে কাগজটা উঠিয়ে নিয়ে এবার ও ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসে। কাগজে কালি দিয়ে হিন্দী শব্দের দুটি লাইন লেখা,"সময় সমীপ, চলনা পড়েগা"।   

কতক্ষণ বসে ছিল, সোমনাথ জানে না, হঠাৎ স্ত্রীর গলার আওয়াজে হুঁশ ফেরে।
'চা বসাও নি'?
'না, এই তো বসাচ্ছি, তুমি মুখ ধোও, হয়ে যাবে'।
'হাতে ও কিসের কাগজ? এখন আর জিনিস আনিও না, এই লক ডাউনের বাজারে কতদিনে বিক্রি হবে তা'?
রিটায়ারমেন্টের পরে সোমনাথ একটা মুদীখানার দোকান খুলেছে। কেবল কলকাতার-ই জিনিস পাওয়া যায় তাতে।
'তুমি মুখ ধুয়ে এস। আমি চা-টা দেখি। বলছি তোমায়'।
আধ ঘন্টা পরে, সোমনাথ নীচে নেমে আসে। সিকিউরিটিকে জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু দুধ যখন দিয়েছে, তখন এরা ছিল না। এরা সকাল আটটায় ডিউটিতে এসেছে। রাতের ছেলেদুটি এখন নেই। এখনকার এরা কিছু জানে না। কথাটা আগে মাথায় আসে নি, যখন বাক্সটা নিচ্ছিল, তখন রাতের ছেলে দুটি ছিল। ওরা আবার রাতে আসবে। ততক্ষণ এ রহস্য অধরাই থেকে যাবে। কেউ কি প্র‍্যাকটিকাল জোক করছে তার সাথে? এই কমপ্লেক্সে তেমন কোন বন্ধু তার নেই৷ তবে কি বাইরে থেকে কেউ ধমকি দিতে চাইছে? কেন? হয়তো নিজে আসে নি, দুধওলা ছেলেটাকে জোর করেছে, বাক্সে কাগজটা রাখার জন্য। কিন্তু তাও কি সম্ভব? সে তো জিজ্ঞাসা করলেই বলে দেবে। সোমনাথের মাথাতে কিছুই আসে না।
" ক্যায়া হুয়া সাহেব?  দুধ ফাটা হুয়া দিয়ে ক্যায়া"?
গুপ্তাজীর প্রশ্নে সোমনাথের ভাবনায় ছেদ পড়ে। হঠাৎ মনে হল, গুপ্তাজী রাতের ছেলেদুটোর আস্তানা জানতেও পারে।
"গুপ্তাজী, আপ রাতওয়ালে দোনো কঁহা রহতে, জানতে হ্যায় কেয়া"?
"হাঁ সাহেব। লেকিন কিউ? কুছ কিয়া ক্যায়া উনহোনে"?
"নেহি নেহি। কুছ মালুমাত করনা থা উনসে"।
"আভি তো সাহেব, পতাহ নেহি, ঘর মে হোগা কি নেহি, দুসরা জগাহ মে ভি ডিউটি বাজাতা হ্যায় না"।
"আভি তো ডিউটি সে ছুটে, আব কঁহা যায়েঙ্গে ডিউটি মে ফির"?
"আরে সাহেব, এক ডিউটি সে পেট নেহি না চলতা। হম লোগ লগভগ সব হি গার্ড দো দো ডিউটি করতে হি হ্যায়। আপ যাইয়ে, ম্যায় পতা লাগাতা হুঁ”।
সোমনাথ ওপরে উঠে আসে। তার মন আরও একটু অশান্ত হয়ে পড়ে। সারাটা দিন ধরে লকডাউনের মধ্যে কোন কিছুই মাথায় আসে না। নমো নমো করে স্নান খাওয়া সেরে দুজনে আবার কাগজটা নিয়ে বসে। অনেক খুঁটিয়েও আর কিছু লেখা বা অন্য কোন চিহ্ন কাগজের কোত্থাও নেই। একদম সাদা কাগজ। তবে প্রথম লাইনের কালিটার রঙ-এর সাথে দ্বিতীয় লাইনটার হালকা তফাত যেন আছে। সেটা আগে পরে লেখার জন্যে বা শুকোনোর জন্যও হতে পারে। আবার ঠান্ডা দুধের থলিগুলো লেগেও হতে পারে। বিকেলের ম্লান আলো ব্যালকনির দরজা দিয়ে দেওয়ালে তির তির করে কাঁপছিল- সোমনাথের চোখের সামনে অজানা সব দৃশ্য যেন ফুটে উঠতে থাকে। একটা ভয়ঙ্কর কিছু হতে চলেছে। এতগুলো দুধের বাক্স নীচে রাখা ছিল, রোজই থাকে, শুধু তার বাক্সেই বা এই কাগজটা কেন এল ? কে দিল? দুধওলা ছেলেটার আজ পর্যন্ত মুখও দেখেনি। এই মুহুর্তে রাস্তার অন্য পারে মুখ ঢেকে সে যদি তার বাড়ির দিকে নজর টিকিয়ে বসেও থাকে, তবুও সে তাকে চিনতে পারবে না। এই কথা মনে হতেই, গেটের দিকে ঘরের ব্যলকনিতে বেরিয়ে আসে ও। না, কেউ দাঁড়িয়ে নেই। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। আর ঘন্টা তিনেকের মধ্যে রাতের ছেলে দুটো আসবে। তখনই এই রহস্যের পর্দা উঠবে- যদি রহস্য থাকে ! 
এখন রাত নটা।
আটটায় সিকিউরিটি বদল হবার পরে, কালকের ছেলে দুটো এসেছে এক ঘন্টা হয়ে গেছে। কিন্তু জানা যায়নি কিছুই। যে দুজন গতরাতে ছিল, তাদের মধ্যে একজনের শরীর খারাপ হওয়ায়, তার বদলি একজন নতুন এসেছে। আরেকজন যদিও কালকে ছিল- কিন্তু ভোরের দিকে তার ঘুমোবার পালা ছিল, তাই সে দুধ-ওয়ালাকে দেখেনি-  আর কাগজের কথাও জানে না। সারা দিনের সমস্ত অপেক্ষার এমন অদ্ভুত পরিণতি হবে সোমনাথ স্বপ্নেও ভাবে নি। তার মন বলছে, বেশি দেরী হয়ে গেলে, পুলিশের কাছে গিয়েও কোন লাভ নাও হতে পারে। কিন্তু এই একটা মাত্র উড়ো কাগজ নিয়ে গিয়ে পুলিশকে কিই বা বলবে? এতে তার নাম বা নম্বর কিছুই লেখা নেই, শুধু তারই দুধের বক্সে ছিল! 
হঠাৎ মাথায় একটা নতুন কথা আসে। আজ ভোররাতেও তো দুধ-ওয়ালা ছেলেটা আসবে। সে নিজেই তো ছেলেটার সাথে কথা বলতে পারে তখন। ইয়েস, এটাই সবচেয়ে সহজ আর সঠিক উপায়। ইন্টারকম থেকে ন-নম্বরে ডায়াল  করে।
‘জী স্যার’?
‘কিতনে বাজে সুবাহ দুধ দেনে আতা হ্যায়’?
‘করিব সাড়ে ছ বাজে স্যার’।
‘কাল সুবাহ মুঝে বুলা লেনা তুরন্ত। মুঝে উস দুধ ওয়ালে সে বাত করনা হ্যায়। ইয়াদ রহেগা’?
‘জরুর স্যার, ম্যায় বুলা লুঙ্গা’।    
স্টেজ তৈরী। এবার কেবল সময়ের অপেক্ষা। কি ভাবে ছেলেটাকে ধরবে, সোমনাথ মনে মনে রিহার্সাল দিতে থাকে। সম্ভাব্য সব রকম অবস্থার প্রশ্নগুলোকে তার মনে মনে সাজিয়ে নেয়। আজ ঘুম আসবে না। সোমনাথ তাও আলোটা  নিভিয়ে দেয়। তার গিন্নী অতটা ভাবছে না, তার মতে কেউ মজা করেছে, বা কারো লেখা, ভুল করে ওদের দুধের বাক্সে এসে গেছে।
সারাদিনের লাগাতার দুশ্চিন্তা সোমনাথকে ভেতর থেকে ক্লান্ত করে দিয়েছিল। তাই যখন ইন্টারকমের ঘন্টি ওর কানে যায়, তখন সে বুঝে উঠতে পারে না, ফোনটা কোথায় বাজছে। দশ সেকেন্ডের মধ্যে তার সব মনে পড়ে যায়।  রিসিভারটা তুলে, ‘আ রহা হুঁ, রোকনা উসকো’ বলেই উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ায় সোমনাথ। কাগজটা ওর পাজামার পকেটে নিয়েই শুয়েছিল।
গেটের কাছে এসে দেখে একটা ১৮-১৯ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে। তার চোখে মুখে কোন রকম বদমায়েশির ছাপ নজরে আসে না। কিন্তু সোমনাথ রিহার্সাল করেই এসেছে।
‘এ কাগজ তুমনে রাখখা থা হমারে দুধ কা বক্স মে? কিউ’?
‘নেহি সাহেব। হাম কিউ রাখেঙ্গে ভলা’?
‘তো তুম ইস পেপার কো জানতে নেহি হো’?
‘নেহি সাব! পর, পর...’
‘ক্যায়া পর..’?
‘স্যার, হে মেরা বাবুজী কা লিখাবট জেইসা হ্যায়। ম্যায় পাক্কা নেহি হুঁ, লেকিন ক্যায়সে হো সকতা হ্যায়’!
‘মতলব ক্যায়া তুমাহারা’?
‘স্যার, বাবুজী গাঁও মে রহতে হ্যায়। ওহ হামেশা শুদ্ধ ভাষা মে হি বাত করতে অউর লিখতে হ্যায়। মুঝে লগ রহা হ্যায়, কি এ বাবুজী কি হি লিখা হুয়া হ্যায়’।
‘সুবাহ সুবাহ মুঝে পাগল সমঝা ক্যায়া’?
‘না সাহেব। মুঝে যো লগা ম্যায় বাতায়া। মুঝে মালুম হ্যায়, উসকা কোই মতলব নেহি হ্যায়, লেকিন...’।
‘বাবুজী কাঁহা রহতে হ্যায়’?
‘স্যার, গাঁও মে, মাঝিয়া, বাবতপুর কে পাশ। ঘর মে কোই ফোন নেহি হ্যায়। লেকিন বগল মে আহমেদ চাচা কা দুকান মে হ্যায়’।
‘নম্বর হ্যায়, নম্বর’?
‘জী’।
‘মুঝে দো’।
‘স্যার, আভি তো উহা কোই উঠা ভি নেহি হোগা’।
‘ও ম্যায় দেখ লুঙ্গা, তুম খালি নম্বর দো। আর তুমাহারা নম্বর ভি সিকিউরিটি কো দে যাও। ম্যায় পোলিশ মে ফোন করতা হু’।
‘আরে সাহেব, পোলিশ কিউ? ম্যায় নে আপকে সাথ কুছ কিয়া তো নেহি। ম্যায় সচ বোল রহা হু। মুঝে নেহি পাতা, এ খত ক্যায়সে আয়া আপকে ব্যাগ মে। ইত্তেফাক হ্যায় যে এ লাগতা হ্যায়,মেরি বাবুজী কি লিখাবট জেইসে হি  হ্যায়’।
‘ঠিক হ্যায়, ম্যায় দেখতা হুঁ, তুম কনটাক্ট মে হি রহনা, সমঝে? নেহি তো মজবুরন মুঝে থানে যানা পড়ে গা। তুমাহারা নাম ক্যায়া হ্যায়’?
‘বাচ্চু যাদব, গাওমে সব মুঝে বাচুয়া বুলাতে হ্যায়’।
‘ঠিক হ্যায়, অব যাও’।
বেলা দশটার সময় আহমেদ চাচার নম্বরে ট্রাই করে সোমনাথ। আর কি আশ্চর্য, একবারেই লেগে যায়। কিন্তু ওপাশ থেকে যা শোনালো, তার কোন কুল কিনারা হাজার ভেবেও করতে পারে না সে। এমনটা কি ভাবে সম্ভব হতে পারে?   
ইন্টারকমটা বাজছে। সোমনাথ ধরতেই, ওপাশ থেকে গুপ্তাজীর গলা, ‘সাহেব কোই খবর ভেজা রাত ওয়ালে কা পাশ, যে বাচুয়া কা পিতাজী কা দেহান্ত হো গিয়া। আপকো বাতানে কো বোলা। ক্যায়া স্যার আপকা নজীক কা কোই হ্যায় ক্যায়া’?
‘ধন্যবাদ গুপ্তাজী। জী। নজিক কা হি থা’। 

বাচুয়া কা পিতাজী সোমবার ভোরবেলা সাড়ে ছটা নাগাদ মারা যান। বাচুয়ার সাথে ওদিককার সবাই যোগাযোগ করার খুব চেষ্টা করে, কিন্তু না ও নিজে, না ওর মালিক, কেউই সময়ে ফোন ধরে না।

পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করে সোমনাথ। ছেলেকে খবর তো পাঠিয়েছিলেন- হয়তো দুধ রাখার আগেই। শুধু বাচ্চু যাদবের চোখে পড়েনি।

চোখের সামনে কাগজটা মেলে ধরে সোমনাথ – এখন সেটা একদম কোরা। দুধের মত সাদা। একটা লাইনও পর্যন্ত নেই।     

Blogging is difficult way to earn money?

  Blogging can be a way to earn money, but it's not always easy. Success depends on factors like your niche, content quality, consistenc...