ভারতবর্ষের উত্তর থেকে দক্ষিণ অথবা পশ্চিম থেকে অজানা পূর্ব পর্যন্ত যেমন আলাদা জাতি, ধর্ম এবং বিভিন্ন খাদ্যাভাসের মানুষ বাস করেন, তাদের পোষাক আশাকও সেই মত বিভিন্ন। সাধারণ সময়ে পরার পোষাক, অনুষ্ঠানে পরার পোষাক বা বিবাহের জন্য সজ্জিত হওয়া সকলই আলাদা আলাদা। শিশু অবস্থায় যেমন ভাবে থাকে, যুবা অবস্থায় তারই সাজ সজ্জার ভোল বদলে যায়। আবার অবসর প্রাপ্ত অবস্থায় পোষাকের স্টাইল বা কোয়ালিটি এক্কেবারেই বদলে যায়। যারা মাঠে বা ক্ষেতে কাজ করেন, পুরুষ অথবা মহিলা, তাদের পোষাক পরিচ্ছদ মাঠের উপযোগী করেই বানানো এবং ব্যবহার হয়।
আমারা আজকের বিষয় হল মাথার পোষাক নিয়ে। মাথায় ভারতবর্ষে সাধারণতঃ যা পরা হয়, তাকে এক কথায় পাগড়ি বলা যায়। কিনতু এই "পাগড়ি" কথাটি জাস্ট একটা ডেফিনিশন ভিত্তিক, যা মাথায় পরা হয়। রাজ্য, রাজওয়াড়া, ক্লাইমেট সামাজিক অবস্থান, এই সব কিছুর উপরে পাগড়ি-র প্রকার ভেদ ঘটে। রাজস্থানে যে পাগড়ি পরা হয়, কচ্ছে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবার মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী এলাকায় মাথায় যে ভাবে পাগড়ি পরা হয়, সুজলা সুফলা বাংলায় তা হয় না।
আজকের ভারতবর্ষে, এই পাগড়ির প্রকারভেদ সত্ত্বেও, তাদের সামাজিক, আর্থিক এবং ব্যক্তিগত মূল্যায়ন মোটামুটি একটাই উদ্দেশ্য প্রকট করে। আর ভারতবাসী হবার দৌলতে আমরা সেটা হৃদয়ঙ্গমও করি। বর্তমান যুগে দেশকালের ব্যপ্ততায় উত্তর থেকে মধ্য ভারত আর পশ্চিম থেকে মধ্যভারত পর্যন্তই পাগড়ির চল এখনও আছে। নেই কেবল পূর্ব ভারতে- বিশেষ করে বাংলায়। তাহলে কি বাংলায় সভ্যতার ক্রমোত্তরণের সাথে সাথে কখনও কি পাগড়ির ব্যবহার এক্কেবারে ছিলই না? অথবা, সভ্যতার কোন বিশেষ ধারায় বঙ্গবাসী তাকে ধীরে ধীরে পরিত্যাগ করেছে? আসুন একটু খোঁজার চেষ্টা করি।
বাঙ্গালার ইতিহাস কমবেশি ৪০০০ বছরের পুরানো। ভারতীয় এই ভূভাগ গ্রীক এবং রোমান দুজনেরই পরিচিত ছিল- তারা এর নাম দিয়েছিল গঙ্গারিডাই। মূল ভারতবর্ষের ইতিহাস গড়তে এই গঙ্গারিডাই ভূখন্ডের অসীম অবদান অনস্বীকার্য্য। মূল ভারতের অনেক প্রাচীন রাজারা এই ভূখন্ড শাসন করেছেন- যেমন মৌর্য্যরা এবং গুপ্ত বংশীয় রাজারা। বাংলা ছিল সমগ্র পূর্ব ভারতের শাসনক্ষমতার এক বড় দূর্গ- গৌড়ের রাজারা এখানে যে দূর্গ বানিয়েছিল, তাকে কেন্দ্র করেই বাংলার শাসক এবং শাসিতেরা যুগে যুগে এই বাংলায় জীবন যাপন করে এসেছে- অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীতে এই রাজ্য শাসন করেন পাল বংশীয়রা যারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তার পরে একশো বছর বাংলা চলে আসে সেন রাজাদের হাতে (লক্ষণ সেন, বল্লালসেন প্রভৃতি), যারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের মধ্যে তখন মূলগত ভাবে বিভেদ ছিল এবং শাসকেরা সেই ভাবেই রাজ্যের প্রজা এবং রাজ্যের নির্মান করে গেছেন। তবে সেন রাজাদের আমলে বাংলার ভাষা, অক্ষর, সাহিত্য, সঙ্গীত, চারুকলা এবং আর্কিটেকচারের সবচেয়ে বেশি উন্নতি সাধন হয়েছিল- যার নিদর্শন আমরা আজকেও সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে দেখতে পাই। এখন কথা হচ্ছে এই সব রাজারা কি মাথায় শিরস্ত্রাণ বা পাগড়ি ব্যবহার করতেন না? এই সব রাজা মহারাজদের ক্যামেরায় তোলা অকাট্য ছবি পাবার সম্ভাবনা নেই- আমাদের সামনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য বা বল্লাল সেনের যে ঐতিহাসিক ছবি আজকে বিদ্যমান, তার বেশির ভাগই সেই সময়কার শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখা এবং আঁকা কিছু কিছু পোর্ট্রেট। সেই পোর্ট্রেট কি বলছে বাংলার রাজাদের মস্তকের শৃঙ্গার নিয়ে ?
মৌর্য্য আমলের যত স্থাপত্য, প্রধানত বৌদ্ধ বিহার (সাঁচী, রাজগৃহ, অমরাবতী, পাটলিপুত্র) , তাতে সুরক্ষিত যে সমস্ত মূর্তি পাওয়া গেছে- তাতে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য মাথায় মুকুট বা শিরস্ত্রাণ পরতেন।
বল্লাল সেন বা লক্ষণ সেনেরও কোন ছবি পাওয়া সম্ভব নয়। তবে যুগের অভ্যাস এবং পদমর্যাদার পরম্পরাগত ঐতিহ্য অনুযায়ী ৯৯ ভাগ মেনে নিতে অসুবিধে নেই- যে এই দুই সেন বংশের রাজারা, যারা আধুনিক বাংলার প্রবর্তক, কুলীন প্রথার প্রবর্তক , তারা মাথায় মুকুট বা উষ্ণীষ অবশ্যই ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ, বাঙ্গালার সাথে ভারতের অন্য ভূখন্ডের মাথার পাগড়ি নিয়ে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত কোন প্রকার বিভেদ নজরে আসছে না। বল্লাল সেনের ঢিপি বলে একটি পুরাকীর্তি স্থাপত্য নদীয়ার মায়াপুরের নিকট আছে- যা কোলকাতা শহর থেকে গাড়িতে করে দু-তিন ঘন্টায় অবশ্যই পৌঁছানো যায়। সেখানে ভারতীয় আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্ট খোঁড়াখুঁড়ি করে কি পেয়েছে , তা নিয়ে এই আলেখ্যয় আলোচনা করছি না, আমার আসল বক্তব্য থেকে ইতিমধ্যেই অনেকটা দূরে চলে এসেছি। তবে পাগড়ির ব্যবহার কি ভাবে ধীরে ধীরে বন্ধ হল, সেটা জানবার জন্য শুরুর থেকেই শুরু করাটা বিধেয় মনে হল। পাঠক নিজগুণে আমাকে ক্ষমা করবেন।
( ক্রমশ.....)
আমারা আজকের বিষয় হল মাথার পোষাক নিয়ে। মাথায় ভারতবর্ষে সাধারণতঃ যা পরা হয়, তাকে এক কথায় পাগড়ি বলা যায়। কিনতু এই "পাগড়ি" কথাটি জাস্ট একটা ডেফিনিশন ভিত্তিক, যা মাথায় পরা হয়। রাজ্য, রাজওয়াড়া, ক্লাইমেট সামাজিক অবস্থান, এই সব কিছুর উপরে পাগড়ি-র প্রকার ভেদ ঘটে। রাজস্থানে যে পাগড়ি পরা হয়, কচ্ছে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবার মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী এলাকায় মাথায় যে ভাবে পাগড়ি পরা হয়, সুজলা সুফলা বাংলায় তা হয় না।
আজকের ভারতবর্ষে, এই পাগড়ির প্রকারভেদ সত্ত্বেও, তাদের সামাজিক, আর্থিক এবং ব্যক্তিগত মূল্যায়ন মোটামুটি একটাই উদ্দেশ্য প্রকট করে। আর ভারতবাসী হবার দৌলতে আমরা সেটা হৃদয়ঙ্গমও করি। বর্তমান যুগে দেশকালের ব্যপ্ততায় উত্তর থেকে মধ্য ভারত আর পশ্চিম থেকে মধ্যভারত পর্যন্তই পাগড়ির চল এখনও আছে। নেই কেবল পূর্ব ভারতে- বিশেষ করে বাংলায়। তাহলে কি বাংলায় সভ্যতার ক্রমোত্তরণের সাথে সাথে কখনও কি পাগড়ির ব্যবহার এক্কেবারে ছিলই না? অথবা, সভ্যতার কোন বিশেষ ধারায় বঙ্গবাসী তাকে ধীরে ধীরে পরিত্যাগ করেছে? আসুন একটু খোঁজার চেষ্টা করি।
বাঙ্গালার ইতিহাস কমবেশি ৪০০০ বছরের পুরানো। ভারতীয় এই ভূভাগ গ্রীক এবং রোমান দুজনেরই পরিচিত ছিল- তারা এর নাম দিয়েছিল গঙ্গারিডাই। মূল ভারতবর্ষের ইতিহাস গড়তে এই গঙ্গারিডাই ভূখন্ডের অসীম অবদান অনস্বীকার্য্য। মূল ভারতের অনেক প্রাচীন রাজারা এই ভূখন্ড শাসন করেছেন- যেমন মৌর্য্যরা এবং গুপ্ত বংশীয় রাজারা। বাংলা ছিল সমগ্র পূর্ব ভারতের শাসনক্ষমতার এক বড় দূর্গ- গৌড়ের রাজারা এখানে যে দূর্গ বানিয়েছিল, তাকে কেন্দ্র করেই বাংলার শাসক এবং শাসিতেরা যুগে যুগে এই বাংলায় জীবন যাপন করে এসেছে- অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীতে এই রাজ্য শাসন করেন পাল বংশীয়রা যারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তার পরে একশো বছর বাংলা চলে আসে সেন রাজাদের হাতে (লক্ষণ সেন, বল্লালসেন প্রভৃতি), যারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্মের মধ্যে তখন মূলগত ভাবে বিভেদ ছিল এবং শাসকেরা সেই ভাবেই রাজ্যের প্রজা এবং রাজ্যের নির্মান করে গেছেন। তবে সেন রাজাদের আমলে বাংলার ভাষা, অক্ষর, সাহিত্য, সঙ্গীত, চারুকলা এবং আর্কিটেকচারের সবচেয়ে বেশি উন্নতি সাধন হয়েছিল- যার নিদর্শন আমরা আজকেও সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে দেখতে পাই। এখন কথা হচ্ছে এই সব রাজারা কি মাথায় শিরস্ত্রাণ বা পাগড়ি ব্যবহার করতেন না? এই সব রাজা মহারাজদের ক্যামেরায় তোলা অকাট্য ছবি পাবার সম্ভাবনা নেই- আমাদের সামনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য বা বল্লাল সেনের যে ঐতিহাসিক ছবি আজকে বিদ্যমান, তার বেশির ভাগই সেই সময়কার শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখা এবং আঁকা কিছু কিছু পোর্ট্রেট। সেই পোর্ট্রেট কি বলছে বাংলার রাজাদের মস্তকের শৃঙ্গার নিয়ে ?
মৌর্য্য আমলের যত স্থাপত্য, প্রধানত বৌদ্ধ বিহার (সাঁচী, রাজগৃহ, অমরাবতী, পাটলিপুত্র) , তাতে সুরক্ষিত যে সমস্ত মূর্তি পাওয়া গেছে- তাতে একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য মাথায় মুকুট বা শিরস্ত্রাণ পরতেন।
বল্লাল সেনের ঢিপি, জিওবাংলার সৌজন্যে প্রাপ্ত
বল্লাল সেন বা লক্ষণ সেনেরও কোন ছবি পাওয়া সম্ভব নয়। তবে যুগের অভ্যাস এবং পদমর্যাদার পরম্পরাগত ঐতিহ্য অনুযায়ী ৯৯ ভাগ মেনে নিতে অসুবিধে নেই- যে এই দুই সেন বংশের রাজারা, যারা আধুনিক বাংলার প্রবর্তক, কুলীন প্রথার প্রবর্তক , তারা মাথায় মুকুট বা উষ্ণীষ অবশ্যই ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ, বাঙ্গালার সাথে ভারতের অন্য ভূখন্ডের মাথার পাগড়ি নিয়ে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত কোন প্রকার বিভেদ নজরে আসছে না। বল্লাল সেনের ঢিপি বলে একটি পুরাকীর্তি স্থাপত্য নদীয়ার মায়াপুরের নিকট আছে- যা কোলকাতা শহর থেকে গাড়িতে করে দু-তিন ঘন্টায় অবশ্যই পৌঁছানো যায়। সেখানে ভারতীয় আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্ট খোঁড়াখুঁড়ি করে কি পেয়েছে , তা নিয়ে এই আলেখ্যয় আলোচনা করছি না, আমার আসল বক্তব্য থেকে ইতিমধ্যেই অনেকটা দূরে চলে এসেছি। তবে পাগড়ির ব্যবহার কি ভাবে ধীরে ধীরে বন্ধ হল, সেটা জানবার জন্য শুরুর থেকেই শুরু করাটা বিধেয় মনে হল। পাঠক নিজগুণে আমাকে ক্ষমা করবেন।
( ক্রমশ.....)